এক চিলতে রোদ্দুর । একটি অসমাপ্ত প্রেমের গল্প


জনাকীর্ন বাসস্ট্যান্ডের যাত্রী ছাউনির এককোণে অল্প একটুখানি জায়গা খালি পড়ে আছে দেখে ছেলেটা এগিয়ে গেল সেদিকে। কিন্তু সেখানে যাবার আগেই দেখলো কোথা থেকে এক কোট-টাই পরা বাবুসাহেব সেই জায়গাটার দখল নিয়ে নিয়েছে। মনেমনে একটু হাসলো ছেলেটা, তারপর বসে একটু জিরিয়ে নেবার স্বপ্নখানা জলাঞ্জলি দিয়ে বের হয়ে গেল যাত্রী ছাউনি থেকে।

abstract_0001

এভাবে তীরে এসে তরী ডোবার ঘটনা যে আজই প্রথম তা কিন্তু না। এটা বলতে গেলে একটা নিত্যকার ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে ছেলেটার জন্য। গত ৬ মাসে তো কম ইন্টারভিউ দিলোনা, কিন্তু লাভের খাতা আজো শূন্য। সবাই শুধু বলে আপনি তো বেশ মেধাবী ছাত্র, দেশসেরা একটা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ফার্স্টক্লাস পেয়েছেন, তাহলে আমাদের মতো অখ্যাত একটা প্রতিষ্ঠানে কেন চাকরির আবেদন করেছেন? ছেলেটা কিছুতেই বোঝাতে পারেনা একখানা চাকরী তার কতোটা প্রয়োজন এই মুহুর্তে। ছেলেটা জীবনে এতোগুলো পরীক্ষায় ফার্স্টক্লাস পেয়ে এসেও বুঝতে পারেনা এতো ভালো ইন্টারভিউ দিয়েও একজন আবেদনকারীর কেন চাকরী হয়না। এদিকে প্রাইভেট পড়িয়ে যা কিছু সঞ্চয় করেছিলো সেগুলোও শেষের পথে। এভাবে আর কতদিন চলবে? কি করবে ছেলেটা সেগুলো ফুরিয়ে যাবার পরে? কিভাবে একমাত্র ছোটবোনের বিয়ে দেবে সে? কিভাবে অসুস্থ মাকে বড় ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাবে?

এসব কথা ভাবতে বসলে আজকাল ছেলেটার মাথায় কিছু কাজ করেনা। এদিকে আত্নীয়স্বজনও বলাবলি শুরু করেছে, একটা চাকরী জোগাড় করতে না পারলে সে আবার কিসের ভালো ছাত্র? এসব ভাবনার ভীড়ে যখন সে ডুবতে বসেছে তখন মাথা তুলে দেখে, তার বাস এসে গেছে এবং বাসের হেলপার বাসে উঠতে তাগাদা দিচ্ছে যাত্রীদের। তাই আর অযথা বসে সময় নষ্ট করলো না ছেলেটা। পরে যদি আবার তাকে না নিয়েই বাসটা ছেড়ে দেয়, কিভাবে পৌছবে  সে চট্টগ্রামে?

বাসের ভিতরে উঠে দেখলো বেশ পিছনের দিকে তার সিটটা, যদিও এসব নিয়ে আজকাল খুব একটা ভাবার কোন অবকাশ নেই। এটা ভেবেই সে খুশি হয় যে বাসের চালক তাকে ভিতরে বসতে দিয়েছে। কিন্তু দিন যেভাবে বদলে যাচ্ছে তাতে কতদিন আর এভাবে বসতে দিবে সেটা নিয়েই সে যথেষ্ট শঙ্কায় আছে। যাইহোক, জানালার পাশের সিটটাতে বসে পাশের সিটে নিজের ক্ষীণকায় ব্যাগটা রাখলো। বাস ছাড়বো ছাড়বো করছে তবুও ছেলেটার পাশের সিটটা খালিই রয়ে গেল। ছেলেটা ভাবলো ভালোই তো হলো, একটু আরাম করে যাওয়া যাবে। পথ তো আর কম দূরের না।

হঠাত ধুপধাপ আওয়াজ সহকারে সদ্য যৌবনপ্রাপ্ত এক তরুনীর আগমন ঘটলো বাসের ভেতরে। অল্পবয়সী ছেলেপুলে যারা ছিলো তারা একটু নড়েচড়ে বসলো মেয়েটিকে একটু ভালো করে দেখার জন্য। শুধু ছেলেপুলে কেন, বয়সে প্রবীন মুরুব্বীরাও তো বাদ গেল না, তারাও আড়চোখে দেখে নিলো মেয়েটিকে। ছেলেটার ভেতরে অবশ্য কোন প্রতিক্রিয়া দেখা গেল না। বাস্তবতার নির্মম কষাঘাতে রোমান্টিসিজম নামক বস্তুটা সেই কবেই যে নির্বাসনে পালিয়েছে তার মন থেকে, তার কোন হিসাব নেই। তাই, এসব আর ছেলেটার মনে আজকাল কোন দাগ কাটেনা। আজকাল অবশ্য এসব সুন্দরী মেয়েদের দেখলে কিঞ্চিৎ বিরক্তই হয় সে।

পুরো বাসটা একনজর দেখে মেয়েটা দেখলো পুরো বাসে একটাই সিট খালি আছে। তাই সে ছেলেটার পাশে এসে জানতে চাইলো, “ভাইয়া ব্যাগটা কি আপনার?”

ছেলেটা মাথা না তুলেই বললো, “জ্বী, আমার। আপনি বসবেন?”

মেয়েটা বললো, “যদি আপনার কোন আপত্তি না থাকে তাহলে আমি কি আপনার পাশে বসতে পারি?”

মনে মনে হাসলেও মুখে একটা গাম্ভীর্য বজায় রেখে ছেলেটা বললো, “আমার কোন সমস্যা নেই। আপনি বসতে পারেন। তবে পিছনের দিকের সিট তো, কতটুকু আরাম করে বসতে পারবেন সেটা বলতে পারবোনা।”

কথাটা বলে ব্যাগটা সিট থেকে তুলে বাংকারে রাখলো ছেলেটা। মেয়েটাও চুপচাপ বসে পড়লো। ছেলেটা সরাসরি মেয়েটার মুখ দেখেনি কিন্তু ধারণা করে নিলো মেয়েটা কোন সম্ভ্রান্ত পরিবারের কেউ হবে নিশ্চয়। কারন, বেশ দামী একটা সুবাস ভেসে আসছে মেয়েটার শরীর থেকে এবং কথাবার্তাতেও যথেষ্ট অভিজাত বলেই মনে হলো। যাইহোক, ঢাকা থেকে চট্টগ্রামের দূরত্বের কারনেই সে যথাসাধ্য চেষ্টা করে এটা এড়িয়ে যেতে। কারন, এতো দীর্ঘক্ষন বাসে বসে থাকা বেশ বিরক্তিকর। যদিও কিছু ভারতীয় বন্ধুর কাছে সে শুনেছে, পশ্চিমবঙ্গ থেকে দিল্লী ট্রেনে করে যেতে প্রায় ২৪ ঘন্টা লাগে। বন্ধু বলতে অবশ্য ফেসবুকের পরিচয়। বিশ্ববিদ্যালয়ে যখন পড়তো তখন সাইবার সেন্টারে গিয়ে মাঝে মাঝে ফেসবুকে সেসব বন্ধুদের খোঁজ খবর নিতো, একটু আধটু চ্যাটিং ট্যাটিং করতো আর কি। কতোদিন ফেসবুকে বসা হয়না, কেমন আছে তার সেসব বন্ধুরা! হঠাৎ বিশ্ববিদ্যালয় জীবনের কথা মনে পড়ে গেল ছেলেটার। একের পর এক স্মৃতিগুলো হুড়মুড়িয়ে মনের ক্যানভাসটাকে রাঙ্গিয়ে দিয়ে যেতে থাকলো। সেই রঙ্গিন ভুবনের বিচরনে কিঞ্চিৎ বাঁধা পড়লো পাশের মেয়েটার কারণে। মেয়েটা ডাকছে মনে হচ্ছে। হ্যা, তাইতো, সত্যিই তো মেয়েটা ডাকছে।

মেয়েটা বললো, “ভাইয়া, আপনার পাশের জানালাটা একটু খুলে দিন না, আমার খুব অস্বস্তি লাগছে।”

ছেলেটা উঠে জানালাটা খুলে দিলো। হঠাত তার খেয়ালে আসলো মেয়েটা বলছে তার অস্বস্তি লাগছে। পরে আবার বমি টমি করে দিবেনা তো? তাই আবার জিজ্ঞেস করলো, “আপনার বমি বমি লাগছে নাকি? সমস্যা হলে বলেন, আমি ওইপাশে বসছি।”

মেয়েটা এবার হেঁসে উঠলো। তার মুক্তার মতো চকচকে দাঁতগুলো ছেলেটাকে কিঞ্চিৎ এলোমেলো করে দিচ্ছিলো কিন্তু সম্বিত ফিরে পেলো মেয়েটার কথা শুনে, “আরে না না, সেরকম কোন সমস্যা নেই। তবে হ্যা, অবশ্যই আপনাকে জানাবো তেমন কিছু হলে।”

আবার চুপচাপ চারপাশ। ছেলেটাও কিছু বলছে না, মেয়েটাও না। কোন মেয়ের সুন্দর দাঁত দেখে যে একটা ছেলের মনে ভাবাবেগ সৃষ্টি হয় সেটা আমার জানা নেই, সম্ভবত সে ছেলেটারও জানা ছিলোনা। কিন্তু, রোমান্টিসিজম বিবর্জিত একটা ছেলের সাথেই আজ এরকম একটা ঘটনা ঘটে যাচ্ছে, এটা কিছুতেই বিশ্বাস হতে চাইছেনা ছেলেটার। মেয়েটাই আবারো এই নিস্তব্ধতার অবসান ঘটালো। বললো, “আমি সামিয়া, ঢাকা সিটি কলেজ থেকে এবার এইচএসসি পাশ করেছি। চট্টগ্রাম যাচ্ছি চুয়েট এর ভর্তি পরীক্ষা দিতে। আর আপনি?”

মেয়েটা প্রশ্ন ছুঁড়ে দিয়েছে ছেলেটার জন্য। উত্তরে ছেলেটা কি বলবে ভেবে পাচ্ছিলো না। সত্য বলবে নাকি মিথ্যা বলবে? সত্যি বললে নিশ্চয় মেয়েটা আর কথা বলতে চাইবেনা, তাই মিথ্যা বলাটাই ভালো হবে। কিন্তু ছেলেটার মন কিছুতেই মিথ্যা বলাতে সায় দিতে চাচ্ছে না।

মেয়েটা কোন উত্তর না পেয়ে বললো, “আচ্ছা ঠিক আছে, বলতে না চাইলে দরকার নেই। আমি কোন উদ্দেশ্য নিয়ে প্রশ্নটা করিনি।”

এর পরে আর কাল বিলম্ব করলোনা ছেলেটা। সিদ্ধান্ত নিলো যা হয় হবে, তবু সত্যি কথাটাই বলবে। বললো, “আমি সজল। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অনার্স শেষ করেছি। আপাতত বেকার, একটা চাকরী খুজছি। বলার মতো আপাতত এটুকুই আছে। আর কিছু জমা নেই।”

সামিয়ার মুখে হাসির স্পষ্ট ছাপ দেখতে পেল ছেলেটা। সে বললো, “আপনি তো বেশ সুন্দর করে কথা বলেন, সজল সাহেব। লেখালেখি করেন নাকি?”

সামিয়ার কথায় ছেলেটা এবার কিঞ্চিৎ লজ্জা পেল। বললো, “আরে ধুর! কি যে বলেন না! কোথায় লেখালেখি আর কোথায় আমি? তো ইঞ্জিনিয়ার হতে যাচ্ছেন, ভেরি গুড। কিসের ইঞ্জিনিয়ার হবেন কিছু ভেবে টেবে রেখেছেন?”

এবার লজ্জায় সামিয়ার মুখখানা রাঙ্গিয়ে গেলো। সে সময় তাকে কী যে অদ্ভুত সুন্দরী লাগছিলো, সে যারা দেখেনি তাদের কিছুতেই বোঝানো যাবেনা। সেই সদ্য সূর্য ডোবা পশ্চিমাকাশের মতো মুখে সামিয়া বললো, “কি মনে হয়! এই হাত দুটো দেখেছেন? এরকম মেহেদী দেওয়া হাতে ইঞ্জিনিয়ার হওয়ার স্বপ্ন মানায়? বলেন! আমার কলেজের বান্ধবীদের দেখেছি, ইঞ্জিনিয়ার হতে হবে বলে কী না করেছে! পাগলের মতো পড়াশোনা করেছে, পূর্ব-পশ্চিম ভুলে। বয়ফ্রেন্ডদের পর্যন্ত সময় দিতোনা শুধুই ইঞ্জিনিয়ার হওয়ার জন্য। আর আপনি কিনা আমাকে বলছেন কিসের ইঞ্জিনিয়ার হবো? মজা করছেন নাকি আমার সাথে? দেখুন, আমার সাথে মজা করলে কিন্তু আমি কেঁদে দিবো বলে রাখলাম।”

এবার সজল সত্যি সত্যি ভয় পেয়ে গেল। কারণ, এই বাসের মধ্যে যদি মেয়েটা কান্নাকাটি শুরু করে তাহলে আর রক্ষা থাকবেনা। পাবলিকের পিটুনিতে সোজা উপরওয়ালার কাছে পৌছে যেতে হবে। তাই, মাফ চাই বাবা। অনেক হয়েছে। আর না!

এদিকে সজলকে চুপকরে যেতে দেখে মেয়েটা ভিতরে ভিতরে উসখুস করতে লাগলো। অবশেষে বলেই ফেললো, “কি ব্যাপার? হঠাৎ মুড অফ হয়ে গেলো কেন? ভালো লাগছেনা কথা বলতে? অবশ্য ভালো না লাগারই কথা। আমার বান্ধবীরাও বলে, আমি নাকি খুব বেশি কথা বলি। আচ্ছা থাক, আর কোন কথা বলতে হবেনা।”

এই কথা বলে সামিয়া মুখ ঘুরিয়ে অন্যদিকে ফিরে রইলো। এদিকে মেয়েটির ছেলেমানুষি দেখে সজল মুখটিপে হাসছে। এই বয়সের মেয়েরা কেমন হয় সেটা যেহেতু ওর অজানা না, তাই ব্যাপারটা খুব বেশি গায়ে মাখলো না সজল। চুপচাপ মেয়েটার কান্ড কারখানা দেখছে। মেয়েটা একবার এদিক আর একবার ওদিক করছে। কিছুক্ষন পরে তো রীতিমতো রেগে গিয়ে সজলকে একটা কড়া ধমক লাগিয়ে দিলো। “এই যে মিস্টার, খুব ভাব ধরা শিখে গেছেন দেখছি! কথাই বলছেন না যে!”

এবার সজল আর না হেঁসে পারলোনা। হাসিটা মনে হয় একটু জোরেই হয়ে গিয়েছিলো। ওপাশের সিটে বসা আংকেল উৎসুক ভাবে তাদের দিকে তাকালো। তাই একটু সতর্ক হয়ে সজল বললো, “তো কি করবো বলেন, আপনিই তো বললেন একটু আগে যে আর কথা বলা লাগবেনা। এখানে আমার কি দোষ? আচ্ছা ভালো কথা, আপনি একা একা চট্টগ্রাম যাচ্ছেন, ভয় লাগছেনা? কেউ যদি আপনাকে ধরে টরে নিয়ে যায়? কিংবা, আপনার বাসা থেকেও আপনাকে এতো দূরের পথে একলা কিভাবে বের হতে দিলো?”

সজলের কথা শুনে তো সামিয়া তেলে বেগুনে জ্বলে উঠলো। “আরে আজব তো! এখন সব দোষ আমার! যান, আমার সাথে কথা বলা লাগবেনা। আপনি জানালা দিয়ে বাইরের দিকে তাকিয়ে থাকুন। খবরদার আমার দিকে তাকাবেন না।”

আবারো হাসি পেল সজলের। সামিয়ার ছেলেমানুষি দেখে বেশ মজা পাচ্ছে সজল। কিছুক্ষনের জন্য একদম বেমালুম ভুলে গেছে তার সকল দুশ্চিন্তার কথা। কিন্তু এভাবে মেয়েটাকে রাগ করতে দেখে তারও আর ভালো লাগছেনা। তাই বললো, “সামিয়া, প্লিজ আমাকে ভুল বুঝবেন না। আমি আসলে আপনার কথা ভেবেই চুপ করে আছি। আপনার সাথে বেশি কথাবার্তা বললে পাশের লোকগুলো আপনাকে খারাপ মেয়ে মনে করতে পারে, যেটা আমি চাই না। আচ্ছা আপনার পরীক্ষা কবে?”

কথা গুলো খুব মনোযোগ দিয়ে শুনলো সামিয়া, কিন্তু কোন প্রতিক্রিয়া দেখালোনা। তাই সজল আবারো বললো, “আরে বাবা, স্যরি বললাম তো!”

এবার সামিয়া বলতে শুরু করলো, “দেখুন মিস্টার, আমাকে কচি খুকি ভাবতে যাবেন না, ঠিক আছে! চিটাগাং আমার নানুর বাড়ি। সেই ৫ বছর বয়স থেকে এই পথে আমার যাতায়াত। আমাকে ধরে নিয়ে যাবে সেরকম বুকের পাটা নিয়ে এই রাস্তায় কেউ চলাফেরা করে না। বুঝলেন! আর আশেপাশের মানুষগুলোর কথা বলছেন না? আই ডোন্ট কেয়ার। তাদের কাজ হলো অন্যেরা কি করছে সেটা নিয়ে গালগল্প করা। আমি যদি ২ দিন না খেয়ে থাকি, দেখবেন আমার আশেপাশের একটা লোকও আমার জন্য একমুঠো খাবার নিয়ে এসে বলবেনা যে তুমি তো না খেয়ে আছো, নাও খাও। সো, তাদের কথা আমার কাছে বলতে আসবেন না। আমি বাসের ভেতর একা একা বোর হচ্ছি এবং আপনার সাথে কথা বলতে ভালো লাগছে তাই একটু কথা বলতে চাইছি। এখন আপনার যদি আমার সাথে কথা বলতে ভালো না লাগে তাহলে সোজাসুজি সেটা বলে দিলেই তো পারেন। এভাবে নাটক করার তো কোন মানে নেই। তাই না?”

এতটুকু একটা মেয়ের মুখে এরকম শক্ত শক্ত কথা শুনে একরকম দিশেহারা হয়ে গেল সজল। এরকম সহজ সরল গোবেচারা টাইপের একটা মেয়ের মুখ দিয়েও যে এরকম কথা বের হতে পারে সেটা তার ধারণায়ও ছিলোনা। তবে যেটা বুঝতে পারলো সেটা হলো, মেয়েটা সোজা সাপ্টা কথা বলতে পছন্দ করে। তাই সোজাসুজিই বলে ফেললো, “আমারও আপনার সাথে কথা বলতে মন্দ লাগছিলো না। কিন্তু আশপাশের লোকগুলোর কথা ভেবেই চুপ ছিলাম। সত্যি কথা বলতে কি, আপনার সাথে কথা বলতে গিয়ে একটা কথাই মনে হচ্ছিলো এইটুকু একটা মেয়ের সাথে কি কথা বলবো! কিন্তু একটু আগে আপনি যেরকম একটা ইওর্কার ডেলিভারি দিলেন, তাতে আমি কেন, লিটল মাস্টার শচীন আসলেও তার ব্যাট বলের লাইনে আনতে পারতো কিনা সন্দেহ আছে। যাইহোক, আমার কথায় কিছু মনে করবেন না, এবং কোন কারনে আমি আপনাকে কষ্ট দিয়ে থাকলে আমি তার জন্য দুঃখিত।”

এবার সামিয়া বললো, “অনেক হয়েছে, এসব দুঃখিত টুকখিত রাখেন। আমি আপনার কতো বছরের ছোট হবো আল্লাহ-ই জানে। আমাকে ‘আপনি’ করে বলতে আপনার লজ্জা লাগছে না? বড় অদ্ভুত লোক তো আপনি! আর একবার যদি আমাকে আপনি করে বলেছেন তো আপনার খবর আছে!”

কথা শেষ না করে সামিয়া আবার বলতে শুরু করলো, “আচ্ছা আমরা মনে হয় ফুড ভিলেজে এসে গেছি, তাই না? চলুন একটু বাইরে যাই। কিছু কেনাকাটা করতে হবে।”

কেনাকাটা করতে হবে শুনে তো সজল চমকে উঠলো। চমকে তো উঠবেই, কারণ তার মানিব্যাগের যে অবস্থা! তাতে কেনাকাটা করতে গেলে বেইজ্জতই হতে হবে। সামিয়া হয়তো সজলের এই চমকে উঠা দেখলো না, কিংবা দেখতে চাইলোনা। সোজা গড গড করে হেটে নেমে গিয়ে হাঁক ছাড়লো, “কি ব্যাপার, নামবেন না নাকি!”

কোন উপায় না দেখে নিচে নামলো সজল। তারপর সামিয়ার পিছু পিছু ঢুকলো ফুড ভিলেজে। সজল অবশ্য এই ধরনের ফুডকোর্ট গুলো দেখলে বরাবর-ই এড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টা করে। কারন আর কিছুই না, এখানকার খাবারের আকাশচুম্বী দাম। এর থেকে পথের ধারের দোকান গুলোতে দাঁড়িয়ে খাওয়া দাওয়াকেই অধিক সাচ্ছন্দের বলে মনে করে সে। সামিয়ার সাথে ফুড ভিলেজে ঢুকে একটা অন্যরকম অভিজ্ঞতা হলো সজলের। যেখানেই যাচ্ছে দেখছে সামিয়াকে সবাই সালাম দিয়ে জানতে চাইছে আপামনি কি লাগবে। যেখানে অন্যেরা সহজে পাত্তাই পাচ্ছে না। যাইহোক, বেশ ঘুরাঘুরির পরে কেনাকাটাও কম করলোনা সামিয়া। ফুড ভিলেজের ভেতরে সজল যতোক্ষন ছিলো ততক্ষন দেখলো এক অন্য সামিয়াকে। খুব গম্ভীর, বিনা প্রয়োজনে কারোর সাথে কথা বলছেনা, বা বললেও জাস্ট হাই, হ্যালো টাইপের। কেনাকাটা শেষ করে ওরা আবার হাটা দিলো বাসের দিকে। হাঁটতে হাঁটতে সামিয়া আবার দুষ্টুমি শুরু করলো। বলে উঠলো, “এর পরে যেদিন দেখা হবে সেদিন কিন্তু আপনি বিল পে করবেন। ঠিক আছে?”

সজলও কম যায় না, “আরে আমি তো আজই বিল পে করতাম। আপনিই তো চিটিং করে বিলটা দিয়ে ফেলেছেন। এর পরে আর এরকম করার সুযোগ আপনি কখনোই পাবেনা।”

বাসে উঠে সজল সামিয়াকে জিজ্ঞেস করলো, “এই দোকানদার গুলো সবাই আপনাকে চিনে, তাই না?”

সজলের কথা শুনে রেগে গেলো সামিয়া। “আপনি দেখি ভারি বেহায়া! আবার আমাকে আপনি করে বলা শুরু করে দিয়েছেন!”

সজল ভুল বুঝতে পেরে তাড়াতাড়ি বললো, “সরি, ভুল হয়ে গেছে। আর হবেনা।”

সামিয়া বললো, “হ্যা, এদের অধিকাংশ-ই আমাকে চেনে। এতো ঘন ঘন আসা হয় যে, শুধু এরা না, আরো অনেকের সাথেই চেনাজানা হয়ে গেছে। যাইহোক, আপনার সাথে আরো অনেক কথা বলবো কিন্তু তার আগে একটু খাওয়া দাওয়া করে নিতে হবে। আসুন, স্টার্ট করে দিন।”

সজলের অবশ্য বেশ অস্বস্তি লাগছিলো সামিয়ার সাথে খেতে। এর কারণ শুধু যে সামিয়া একটা অচেনা মেয়ে তা না, প্রতি মুহুর্তে সামিয়ার কাছে ছোট হয়ে যাচ্ছে সে। এতটুকু একটা মেয়ে সবকিছুতেই তার থেকে অধিক ম্যাচিউরিটির পরিচয় দিয়ে চলেছে। এক পর্যায়ে সামিয়ার পীড়াপীড়িতে যোগ দিলো সজল। খাওয়া-দাওয়া করে কিছুক্ষন বিশ্রামের বিরতি। আইডিয়াটা যদিও সামিয়ার-ই ছিলো কিন্তু সেখানে বিশ্রাম কতটুকু হয়েছিলো সেটা নিয়ে যথেষ্ট বিতর্কের অবকাশ আছে। সজলকে একটু চোখ বুজতে দেখলেই ঘুম ভাঙ্গিয়ে সামিয়া জিজ্ঞেস করেছে বিশ্রাম কেমন হচ্ছে। এক পর্যায়ে বিশ্রামও পন্ড হয়ে গেছে। শুরু হয়েছে সামিয়ার নন-স্টপ বকবক। কোন একবিন্দুতে বাঁধা না থেকে সে ঘুরে বেড়িয়েছে এ ডাল থেকে ও ডালে।

আর সজল! নীরব শ্রোতার মতো, মন্ত্রমুগ্ধের মতো শুনে চলেছে সামিয়ার সেসব কথা। এভাবে পথও একসময় ফুরিয়ে এলো। কিন্তু সামিয়ার কথা আর শেষ হয়না। বাস চট্টগ্রামে থামার পরেও প্রায় আধাঘন্টা দাঁড়িয়ে কথা বললো সামিয়া। তারপরে যাবার আগে একটুকরো কাগজে তার বাসার ঠিকানা লিখে দিয়ে গেলো। তারপরে বিদায় নিয়ে কয়েক কদম এগিয়েও আবার ফিরে এলো। খুব জরুরী একটা কথা নাকি বলা বাকি রয়ে গেছে। তারপরে সজলের কানের কাছে ফিসফিস করে বললো,

“আপনি অনেক ভালো একটা ছেলে সজল ভাইয়া। আমি আল্লাহর কাছে দোওয়া করি তিনি যেন আপনাকে অনেক বড় করেন। গত কয়েক ঘন্টায় আমি আপনাকে যতো জ্বালাতন করেছি, আপনার জায়গায় অন্যকেউ হলে নিশ্চিত আমাকে কষে একটা থাপ্পড় লাগাতো। আমিও সচরাচর অবশ্য এরকম করিনা। কিন্তু আপনাকে দেখে কেন যে এরকম করলাম, ঠিক বুঝলাম না। যদি খারাপ কিছু করে থাকি, তো মাফ করে দিবেন। তবে আমি যেতে যেতে আবার ফিরে আসলাম কেন জানেন? আপনাকে ধন্যবাদ দেবার জন্য। সত্যি আপনি অন্যরকম। আপনার জায়গায় অন্য কেউ হলে হয়তো আমার ফোন নম্বর চাইতো, আমার বয়ফ্রেন্ড আছে কিনা জানতে চাইতো। আপনাকে ধন্যবাদ অন্যদের থেকে আলাদা হবার জন্য। আমার বাসার ঠিকানা তো আগেই দিয়েছি। সময় করে অবশ্যই আসবেন আমাদের বাসায়। আম্মু আপনাকে দেখলে অনেক খুশি হবে। ভালো থাকবেন, এবং আমার জন্য দোওয়া করবেন। যেন ইঞ্জিনিয়ার হয়ে বাবার ইচ্ছাটা পূরন করতে পারি।”

এবার সামিয়া সত্যি সত্যিই চলে গেল। সামিয়ার শুন্যতা সত্যিই আমাকে কিছুক্ষনের জন্য আবেগশুন্য করে দিলো। চেয়ে দেখলাম সামিয়ার চলে যাওয়া। অনেক ইচ্ছা করছিলো সামিয়াকে ফিরিয়ে আনি। আরো কিছুক্ষন আমার সাথে থাকতে বলি। কিন্তু কিভাবে বলবো? কোন যোগ্যতায় বলবো? একদিন ফুড ভিলেজের বিল দেবার মতো টাকা যার পকেটে নেই, সেই আমি কিভাবে সামিয়াকে পিছু ডাকবো? তার চেয়ে বরং দূরে থাকি, সেই ভালো। সামিয়া না হয় এক চিলতে রোদ্দুর হয়েই থাক আমার শ্রাবণের আকাশে। শত অভাবের বর্ষনের মাঝে এক টুকরো রোদ হয়ে বিলিয়ে যাক একটুখানি খুশির আভা।

Leave a comment